গণতন্ত্রের মড়ক
বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ ভারত। এই অবস্থান অবশ্য জনসংখ্যার নিরিখে। সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতার নিরিখে তার স্থান ১৪০এ। কিন্তু একথা ঠিক যে, ষাটের দশক থেকে এদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত আছে। সত্তরের দশকের মাঝামাঝি দু’বছরের জরুরি আইনের শাসন বাদ দিলে ভারতে কেন্দ্র ও রাজ্যগুলিতে নিয়মিত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। এক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচন বিশেষভাবে নজর কাড়ে এজন্য যে, প্রায় ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ মানুষ এই নির্বাচন প্রক্রিয়ায় অংশ গ্রহণ করে, যা ভারতের অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় একটা রেকর্ড সৃষ্টিকারি ঘটনা।কিন্তু লজ্জার কথা হল, এত বছর গণতান্ত্রিক আবহ থাকা সত্ত্বেও তার পরিণত চেহারা আজও আমরা দেখছি না। প্রশ্ন হল কেন এমন হল। ভারতের খ্যাতনামা সাংবাদিক কুলদীপ নায়ার বলেছেন, ভারতের শাসকরা ‘সোললেস’ হয়ে পড়েছেন। রজনী কোঠারির বিবেচনায় ভারত একটি ‘ফেইলড ডেমোক্রেটিক স্টেট’। অরুন্ধুতি রায় বলেছেন, ‘ব্রোকেন রিপাবলিক’। তিন প্রজন্মের তিনজন বিশিষ্ট ব্যাক্তির ভাষ্য ভারতকে কাঠগড়ায় তুলেছে। পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলের পোষ্টমটেম করলে উল্লেখিত ভাষ্যকারদের বক্তব্য জীবন্ত হয়ে ওঠে। বিশেষ করে কুলদীপ নায়ারের ভারতের শাসকদের সোললেস হয়ে ওঠার অভিযোগ বৈধতা পেয়ে যায় অনায়াসে। বিগত বছরগুলিতে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের দিকে তাকালে দেখা যায়, মানুষের মৃত্যু ছাড়া শাসক বা বিরোধীদের আন্দোলন মাথা তোলে না। রাজনৈতিক নেতারা প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডে মদত দিয়ে চলেছেন। রাজনৈতিক কোনো নীতি-আদর্শ তাদের কাছে নির্বাচনি অস্ত্র হয়ে ওঠে না। প্রধান অস্ত্র হল মানুষের রক্ত অথবা মৃত্যু। এবং এক্ষেত্রে শিক্ষা-দিক্ষাহীন আর্থিক দিকদিয়ে পিছিয়ে পড়া সংখ্যালঘু ও আদিবাসিরাই তাদের দাবার বোড়ে হয়ে ওঠে। এদের মৃত্যু দিয়েই কেনা হয় তথাকথিত গণতান্ত্রিক ক্ষমতা। রাজনৈতিক দলগুলি চাইলেই কি এই সমস্ত মানুষদের মধ্যে গণতন্ত্রতান্ত্রিক ব্যবস্থা সম্পর্কে রাজনৈতিক-সচেতনতা গড়ে তুলতে পারেন না? পারেন না পিছিয়ে পড়া মানুষদের জন্য শিক্ষার ব্যবস্থা ও আর্থিক উন্নতির জন্য সদর্থক নীতি ও কর্মসূচী গ্রহণ করতে? ইমাম ভাতা দিয়ে ও মাদ্রাসার অনুমোদন দিয়ে কিম্বা পিছিয়ে পড়াদের দু’টাকা দরে চাল দিয়ে তাদের মৌলিক কোনো উন্নতি সম্ভব নয়, তা কি রাজনৈতিক নেতারা জানেন না? জানেন, এবং সচেতনভাবেই তারা পিছিয়ে পড়াদের জন্য সদর্থক পথ মাড়ান না। আর এখানেই কুলদীপ নায়ারের উপলব্ধির যথার্থতা।
তাই গণতন্ত্রের সুস্থ্য পরিবেশ গড়ে তুলতে হলে, রাজনৈতিক নেতাদের পিছিয়ে পড়াদের শিক্ষার এবং আর্থিক উন্নতির জন্য কর্মসূচী গ্রহণ করতে হবে, তা রুপায়নে সদিচ্ছা দেখাতে হবে। তবেই বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ হিসাবে মাথা উচু করে দাড়াতে পারবে ভারত। না হলে, এই দাবি হাস্যস্পদ হয়ে দাঁড়াবে বিশ্ববিবেকের কাছে, থামবে না গণতন্ত্রের মড়ক।
Comments
Post a Comment