বাঙালি জাতিস্বত্তা ও তার সংকট :
মাঝে মাঝে একটা বিষয় মাথায় এসে ঘোট পাকায়; না, বলা ভালো একরাশ প্রশ্ন জড় করে দেয়। তাদেরই একটা হল – আমরা আগে বাঙালি, না হিন্দু-মুসলিম? বলা বাহুল্য, বাঙালি জাতি তার জাতিস্বত্তাকে ভুলতে বসেছে। তাই তারা হিন্দু বা মুসলিম - এই পরিচয়কে আগে আনতে চাইছে। আর ভুলতে বসেছে বলেই এই প্রশ্নটা প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে। আমার মনে হয়, আমরা আগে বাঙালি তারপর হিন্দু বা মুসলিম। এই জাতিস্বত্তাকে জাগিয়ে তুলতে না পারলে বাঙালি আগে যেমন সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্তে বিভক্ত হয়েছে, তেমনি আবারও সে হয় বিভক্ত হবে, না হয় তার জাতিস্বত্তা বিলুপ্ত হবে।এখন দ্বিতীয় প্রশ্ন হল, এই সংকট থেকে বাঙালির মুক্তি কিভাবে? লাখ নয়, কোটি কোটি টাকার প্রশ্ন এটা। আসুন ভেবে দেখি।
আমরা যদি খোলা মনে প্রশ্ন করি, মানুষের জন্য ভাষা আগে এসেছে, না ধর্ম? সেই সঙ্গে আমরা যদি মানব সভ্যতার ইতিহাস ও তার বিবর্তনকে স্বীকার করি এবং যুক্তিবাদী হই, তাহলে মানতেই হবে, আগে ভাষা এবং তার অনেক পরে ধর্ম এসেছে। ভাষাই মানুষকে ভাবনা বিনিময় করতে শিখিয়েছে, আর তার মাধ্যমেই মানুষ জীবন-ধারণের উন্নত পথ ও পদ্ধতি বের করে মানব সভ্যতার জন্ম দিয়েছে এবং সর্বপরি তাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার রসদ খুঁজে পেয়েছে। বিবর্তনের পথ হেটে মানুষ আরও অনেক পরে ধর্মকে হাতিয়ার করেছে। বলা বাহুল্য, ভাষার সাহায্য ছাড়া ধর্মের উদ্ভব ও ক্রমবিবর্তন তাই অলীক কল্পনামাত্র। সুতরাং ভাষাকে উপেক্ষা করে ধর্মকে আঁকড়ে যদি কোন জাতি বেড়ে ওঠার চেষ্টা করে তবে তা হবে শিকড় কেটে আলোর অভিমুখে ছোটার অপচেষ্টা যা ব্যর্থ হতে বাধ্য। ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের দিকে নজর দিলে এবং সেখানকার নৈব্যাক্তিক ইতিহাসের ওপর বিশ্লেষণী দৃষ্টি ফেললে এর সত্যতা পরিমাপ করা যায়।
তাই বাঙালির জন্য ধর্মমুক্ত এবং ভাষাভিত্তিক একটি অভিন্ন সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল গড়ে তোলা খুবই জরুরি। অর্থাৎ ধর্ম নয়, সম্প্রদায় নয়, কেবলমাত্র বাংলা ভাষাই হবে এই সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলের ভিত্তি। আমরা লক্ষ্য করেছি, বাঙালির সাংস্কৃতিক পরিমন্ডল নিদারুণ ভারসাম্যহীনতার শিকার হয়ে পড়েছে। এই ভারসাম্যহীনতার দোলায় ভয়ঙ্কর ভাবে দুলছে এপার বাংলা যেমন, তেমনি ওপার বাংলাও। এপার বাংলার সংখ্যাগুরু মানুষ ভাবে, বাঙালি মানে হিন্দু এবং বাংলা সংস্কৃতি মানে হিন্দু সংস্কৃতি। দূর্ভাগ্যের হলেও সত্যি, ওপার বাংলার একটা বড় অংশ ঠিক একই রকম ভাবে এর উল্টোটাই ভাবে। তাই ওপার বাংলার সাংস্কৃতিক অঙ্গনে সংখ্যালঘুর অংশগ্রহণ যেমন হয়ে পড়েছে আণুবীক্ষণিক, এপার বাংলার অবস্থাও তথৈবচ।
আসলে বাংলা সংস্কৃতির শিকড় এই ‘হিন্দু’ কিম্বা ‘ইসলাম’ কোন ধর্মীয় দর্শনের গভীরে গ্রথিত নেই। কারণ, দুটো ধর্মই হল বহিরাগত। তাই বাঙালীর নিজস্ব স্বত্ত্বা এই ধর্মদুটোর কোনটার মধ্যেই খুঁজে পাওয়া যায় না। এর শিকড় রয়েছে বাঙালি জাতি ও বাংলা ভাষার গর্ভগৃহে। এই কারণেই বাংলা-সংস্কৃতি অঙ্গনের এই ভারসাম্যহীনতা। এই ভারসাম্যহীনতা দূর করতে পারলেই বাঁচবে বাংলা ভাষা, বাচঁবে বাংলা ও বাঙালির সংস্কৃতি। আর এর জন্য প্রয়োজন সমন্বয়ী ‘গলার আওয়াজ’, সমন্বয়ী ‘সংগীতের সুর’, আর সেই সমন্বয়ী ‘ধ্বনি’ বা ‘আওয়াজ’ যা অন্যের (কোন বিশেষ ধর্ম বা সম্প্রদায়ের) সাহায্য ছাড়াই একমাত্র বাঙালীকেই করতে হবে জোরের সঙ্গে উচ্চারণ।
--------------------------------
Comments
Post a Comment