Skip to main content

বাংলা সাহিত্য : সম্পাদকীয়। সেপ্টেম্বর। ২০১৮

বাঙালি জাতিস্বত্তা ও তার সংকট :

বাঙালি জাতিস্বত্তা ও তার সংকট :
মাঝে মাঝে একটা বিষয় মাথায় এসে ঘোট পাকায়; না, বলা ভালো একরাশ প্রশ্ন জড় করে দেয়। তাদেরই একটা হল – আমরা আগে বাঙালি, না হিন্দু-মুসলিম? বলা বাহুল্য, বাঙালি জাতি তার জাতিস্বত্তাকে ভুলতে বসেছে। তাই তারা হিন্দু বা মুসলিম - এই পরিচয়কে আগে আনতে চাইছে। আর ভুলতে বসেছে বলেই এই প্রশ্নটা প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে। আমার মনে হয়, আমরা আগে বাঙালি তারপর হিন্দু বা মুসলিম। এই জাতিস্বত্তাকে জাগিয়ে তুলতে না পারলে বাঙালি আগে যেমন সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্তে বিভক্ত হয়েছে, তেমনি আবারও সে হয় বিভক্ত হবে, না হয় তার জাতিস্বত্তা বিলুপ্ত হবে।

এখন দ্বিতীয় প্রশ্ন হল, এই সংকট থেকে বাঙালির মুক্তি কিভাবে? লাখ নয়, কোটি কোটি টাকার প্রশ্ন এটা। আসুন ভেবে দেখি।

আমরা যদি খোলা মনে প্রশ্ন করি, মানুষের জন্য ভাষা আগে এসেছে, না ধর্ম? সেই সঙ্গে আমরা যদি মানব সভ্যতার ইতিহাস ও তার বিবর্তনকে স্বীকার করি এবং যুক্তিবাদী হই, তাহলে মানতেই হবে, আগে ভাষা এবং তার অনেক পরে ধর্ম এসেছে। ভাষাই মানুষকে ভাবনা বিনিময় করতে শিখিয়েছে, আর তার মাধ্যমেই মানুষ জীবন-ধারণের উন্নত পথ ও পদ্ধতি বের করে মানব সভ্যতার জন্ম দিয়েছে এবং সর্বপরি তাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার রসদ খুঁজে পেয়েছে। বিবর্তনের পথ হেটে মানুষ আরও অনেক পরে ধর্মকে হাতিয়ার করেছে। বলা বাহুল্য, ভাষার সাহায্য ছাড়া ধর্মের উদ্ভব ও ক্রমবিবর্তন তাই অলীক কল্পনামাত্র। সুতরাং ভাষাকে উপেক্ষা করে ধর্মকে আঁকড়ে যদি কোন জাতি বেড়ে ওঠার চেষ্টা করে তবে তা হবে শিকড় কেটে আলোর অভিমুখে ছোটার অপচেষ্টা যা ব্যর্থ হতে বাধ্য। ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের দিকে নজর দিলে এবং সেখানকার নৈব্যাক্তিক ইতিহাসের ওপর বিশ্লেষণী দৃষ্টি ফেললে এর সত্যতা পরিমাপ করা যায়।

তাই বাঙালির জন্য ধর্মমুক্ত এবং ভাষাভিত্তিক একটি অভিন্ন সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল গড়ে তোলা খুবই জরুরি। অর্থাৎ ধর্ম নয়, সম্প্রদায় নয়, কেবলমাত্র বাংলা ভাষাই হবে এই সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলের ভিত্তি। আমরা লক্ষ্য করেছি, বাঙালির সাংস্কৃতিক পরিমন্ডল নিদারুণ ভারসাম্যহীনতার শিকার হয়ে পড়েছে। এই ভারসাম্যহীনতার দোলায় ভয়ঙ্কর ভাবে দুলছে এপার বাংলা যেমন, তেমনি ওপার বাংলাও। এপার বাংলার সংখ্যাগুরু মানুষ ভাবে, বাঙালি মানে হিন্দু এবং বাংলা সংস্কৃতি মানে হিন্দু সংস্কৃতি। দূর্ভাগ্যের হলেও সত্যি, ওপার বাংলার একটা বড় অংশ ঠিক একই রকম ভাবে এর উল্টোটাই ভাবে। তাই ওপার বাংলার সাংস্কৃতিক অঙ্গনে সংখ্যালঘুর অংশগ্রহণ যেমন হয়ে পড়েছে আণুবীক্ষণিক, এপার বাংলার অবস্থাও তথৈবচ।

আসলে বাংলা সংস্কৃতির শিকড় এই ‘হিন্দু’ কিম্বা ‘ইসলাম’ কোন ধর্মীয় দর্শনের গভীরে গ্রথিত নেই। কারণ, দুটো ধর্মই হল বহিরাগত। তাই বাঙালীর নিজস্ব স্বত্ত্বা এই ধর্মদুটোর কোনটার মধ্যেই খুঁজে পাওয়া যায় না। এর শিকড় রয়েছে বাঙালি জাতি ও বাংলা ভাষার গর্ভগৃহে। এই কারণেই বাংলা-সংস্কৃতি অঙ্গনের এই ভারসাম্যহীনতা। এই ভারসাম্যহীনতা দূর করতে পারলেই বাঁচবে বাংলা ভাষা, বাচঁবে বাংলা ও বাঙালির সংস্কৃতি। আর এর জন্য প্রয়োজন সমন্বয়ী ‘গলার আওয়াজ’, সমন্বয়ী ‘সংগীতের সুর’, আর সেই সমন্বয়ী ‘ধ্বনি’ বা ‘আওয়াজ’ যা অন্যের (কোন বিশেষ ধর্ম বা সম্প্রদায়ের) সাহায্য ছাড়াই একমাত্র বাঙালীকেই করতে হবে জোরের সঙ্গে উচ্চারণ।
--------------------------------

Comments

Popular posts from this blog

বাংলা সাহিত্য : সম্পাদকীয় - সমাজ বদলাবে - এটাই চিরন্তন - আলী হোসেন

সমাজ বদলাবে - এটাই চিরন্তন সমাজ বদলাবে - এটাই চিরন্তন। মানব সভ্যতার সূচনা থেকেই শুরু হয়েছে এই বদলে যাওয়ার যাত্রা। সেই যাত্রা মানুষ থামায় নি, থামবেও না। কিন্তু বদলে যাওয়ার গতি এতটাই বেগবান হয়েছে যে, একে আর‘ধীর গতি’ বা বাতাসের ‘মৃদুমন্দ’ গতির সাথে তুলনা করা যাচ্ছে না। বিগত তিন দশক ধরে তথ্যপ্রযুক্তিকে হাতিয়ার করে মানব সভ্যতা যে বেগে বিকশিত হচ্ছে তার তুলনা ইতিহাসে নেই। আর একারণেই এই বদলে যাওয়াকে আমরা কোন মতেই উপেক্ষা করতে পারব না।   সাহিত্য চর্চার মাধ্যম এই ‘বদল-ঝড়ের’ মুখে পড়েছে। মুদ্রণ-নির্ভর সাহিত্য চর্চার যে ধারা, তার বিকল্প মাধ্যম মুদ্রণ-সাহিত্যের ঘাড়ে বিষ-নিঃশ্বাস ফেলছে। এই বিকল্পকে (বদলকে) মেনে নেওয়া ছাড়া কোন উপায় নেই। আর এই বদলে যাওয়া মাধ্যমটাই হল ‘অন-লাইন’ মাধ্যম। বদলাতে যখন হবেই, তখন আসুন-না, একটু আগে-ভাগেই বদলাই।   তাছাড়া, অন-লাইন মাধ্যমের কিছু সুবিধাও আছে। ১) প্রতেক পাঠক লেখা পড়ার পর নিজস্ব মতামত জানানোর স্বাধীনতা পায়, মুদ্রণ-সাহিত্যে যা সবসময় পাওয়া যায় না। এতে পাঠক-লেখক কাছাকাছি আসতে পারেন দ্রুত এবং সহজেই। ২) পাঠকের ভৌগোলিক সীমানা সীমাহীন হয়ে যায়। ৩) পাঠক

বাংলা সাহিত্য : সম্পাদকীয়। অক্টোবর। ২০২০। আলী হোসেন

সমাজতন্ত্রই প্রকৃত পথ। সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে লক্ষ্যে পৌঁছানোর পদ্ধতি এবং প্রকৌশল বদলায়। বিংশ শতাব্দীর পৃথিবীতে যে পদ্ধতিতে বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে, সেই পদ্ধতিতে বিপ্লব (পরিবর্তন) করা আজ অনেক কঠিন। তার প্রয়োজন আছে বলেও আমার মনে হয় না। মতপার্থক্যের কথা বলছেন? তা তো থাকবেই। ধনতান্ত্রিকদের মধ্যে মত পার্থক্য নেই? তারা বিভিন্ন দলে বিভক্ত নয়? সুতরাং মতপার্থক্য থাকবে। আর এটাই স্বাভাবিক। এই মতপার্থক্যকে মতৈক্যে পরিণত করার দায় এবং দায়িত্ব একমাত্র জনগণেরই নিতে হয়। আমার, আপনার এবং আমাদেরই নিতে হবে। আমরা যদি বুঝতে পারি, দুটো অর্থনৈতিক ব্যবস্থার (ধনতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক) মধ্যে কোনটা আমাদের জন্য উপযুক্ত, তাহলে সেই ব্যবস্থার সমর্থকদেরকে আমাকে নির্বাচিত করতে হবে। তারা বহু দলে বিভক্ত হলেও, একটি নির্দিষ্ট মতাদর্শের ভিত্তিতে তারা ঐক্যবদ্ধ হতে পারে। ঐক্যবদ্ধ যে হতে পারে, তার উদাহরণ বামফ্রন্ট তৈরি হওয়া, ইউপিএ তৈরি হওয়া এবং এনডিএ তৈরি হওয়া। মানুষ যেদিকে যাবে, রাজনৈতিক দল সেই দিকেই পথ হাঁটতে বাধ্য হবে। এটাই ইতিহাসের শিক্ষা। এখন আমি বা আপনি, এককথায় আমাদেরকেই ঠিক করতে হবে, আমরা কোন মতাদর্শের পক

বাংলা সাহিত্য : সম্পাদকীয় : চেতনার জন্ম কিংবা মৃত্যু

সম্পাদকীয় : চেতনার জন্ম কিংবা মৃত্যু শিক্ষা আনে চেতনা আর চেতনা আনে বিপ্লব। এটা যে শুধু স্লোগান নয়, পরম সত্য তা আরও একবার প্রমানিত হল। প্রামাণ করলো ছোট্ট মেয়ে মালালা ইউসুফজাই। পাকিস্তানের সোয়াত উপত্যকার মেয়ে মাত্র এগার বছর বয়সেই বুঝে ফেলেছে চেতনাহীন মানুষ পূর্ণ-মানুষ নয়; মানুষের রূপ পাওয়া একটা সাধারণ জীব-মাত্র। মানুষের সঙ্গে এইসব জীবের প্রধান পার্থক্যই নিহিত রয়েছে চেতনা থাকা আর না-থাকার মধ্যে। বস্তুত, চেতনা-রহিত মানুষ হিংস্র পশুর চেয়েও ভয়ঙ্কর হয়। কিন্তু লক্ষ্য করার বিষয় হল, হিংস্র পশু ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে মুলতঃ দুটো কারণে। এক. ক্ষুন্নিবৃত্তি দুই. আত্মরক্ষা; যা প্রত্যেক জীবের সহজাত প্রবৃত্তি। আর চেতনাহীন মানুষের ভয়ঙ্কর ও হিংস্র হওয়ার পিছনে এদুটো প্রবৃত্তির কোনটারই কোন ভুমিকা থাকে না। ২৬/১১য় আজমল কাসবরা যা করেছিল কিম্বা মালালাকে যারা হত্যা করার চেষ্টা করেছে তা ক্ষুন্নিবৃত্তির জন্য নয়, আত্মরক্ষার জন্যও নয়। এক্ষেত্রে চেতনার মৃত্যুই একমাত্র কারণ। অন্যদিকে এই চেতনার সরব উপস্থিতিই মালালাকে করেছে বিপ্লবী। চেতনার খোঁজে তার লড়াই শুরু মাত্র এগার বছর বয়সেই। নারী শিক্ষার বিরুদ্ধে তা