Skip to main content

বাংলা সাহিত্য : সম্পাদকীয়। এপ্রিল। ২০১৯

ধর্ম ও সংস্কৃতির সম্পর্ক : সেঁজুতিকে খোলা চিঠি :

ধর্ম ও সংস্কৃতির সম্পর্ক
সাথি সেঁজুতি,
তুমি সুন্দর করে একটি নেতিবাচক ভাবনাকে ইতিবাচক ভাবনায় রূপান্তর ঘটালে। আসলে এই সহনশীলতার আজ বড়ই অভাব। এখানে (বাংলা সাহিত্য হোয়াটস অ্যাপ গ্রূপে) আমরা যারা আছি তাঁরা নিশ্চয়ই এভাবে ভাবতে পারি হয়তো। আমিতো খুবই পারি।

কিন্তু সমস্যাটা অন্য জায়গায়। একটু খুলে বলার চেষ্টা করি।

প্রথমত: ধর্ম ও সংস্কৃতির মধ্যে যে সম্পর্ক তা বেশ জটিল। আমরা এই দুটিকে এক করে ফেলি। আসলে এই দুইয়ের মধ্যে অতিসূক্ষ অথচ তাৎপর্যপূর্ণ পার্থক্য আছে।

সংস্কৃতি বললে একটি জনগোষ্ঠীর যে যে আচার-ব্যবহার, রীতিনীতি, অনুষ্ঠান ও জীবনযাপন প্রক্রিয়া ইত্যাদিকে বুঝি তার মধ্যে ধর্ম একটি অতি ক্ষুদ্র অংশ। ধর্ম ছাড়াও আরও অনেক অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আছে যা এর অন্তর্ভুক্ত। এখন এই অন্য বিষয়গুলির যেকোনো একটিকে চর্চার বিষয় করলে সবাই (জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে) তাকে সংস্কৃতি চর্চা বলে আখ্যায়িত করবে। এবং সেখানে অন্য ধর্মের মানুষও নির্দ্বিধায় অংশ গ্রহণ করবে।

কিন্তু সংস্কৃতির যে অংশ ধর্ম হিসাবে পরিচিত, তা সব ধর্মের মানুষ একটি বিশেষ ধর্মকে নিজের সংস্কৃতি হিসাবে গ্রহণ করবে না। তাই বিশেষ কোন ধর্ম চর্চাকে সংস্কৃতি চর্চা বলে গণ্য করলে অন্য ধর্মের মানুষ তাতে অংশ নেবে না। যেমন, বাঙালি সংস্কৃতি বা ভারতীয় সংস্কৃতি বললে সেখানে অনেক ধর্মের মানুষের অন্তর্ভুক্তির কারণে জন্ম নেওয়া একটি মিশ্র সংস্কৃতির ধারণা উঠে আসে, যেখানে বিভিন্ন ধর্মের মানুষের সহজ ও স্বচ্ছন্দ গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। মহামতি আকবর এমনই একটি ধর্ম তথা সংস্কৃতির জন্ম দেওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছিলেন। আদতে কাজটা খুবই কঠিন। ধর্মকে বাদ দিয়েই কেবলমাত্র সেই সংস্কৃতির জন্ম হওয়া অপেক্ষাকৃত সহজ ছিল, যেটা আকবর উপলব্ধি করতে পারেন নি। তৎকালীন সময়ের প্রেক্ষিতে সেটা (উপলব্ধি করাটা ) কঠিনও ছিল।

কেন?

আসলে, হিন্দু (এখানে ধর্ম হিসাবেই ধরা হচ্ছে) বা ইসলাম সহ অন্যান্য ধর্ম-কেন্দ্রিক সংস্কৃতি চর্চার চেষ্টা হলেই সেখানে বিপরীত ধর্মীয় মতে বিশ্বাসী মানুষ তা নিজের সংস্কৃতি বলে আর মানতে পারছেন না। অর্থাৎ তারা কিন্তু অন্যের ধর্ম বা ধর্মীয় আচার-আচরণকে নিজের সংস্কৃতি বলে মেনে নিচ্ছেন না।

এখন এই যদি হয় অবস্থা তবে আমরা কিভাবে ধর্মকে (বাংলা বা ভারতীয় প্রেক্ষাপটে) সংস্কৃতি বলে গণ্য করবো?

আসলে এই কারণেই আমরা বাঙালি বলি আর ভারতীয় বলি কোনও স্পষ্ট মৌলিক কোন সংষ্কৃতির জন্ম দিতে পারিনি। এখন দুই বাংলায় ধর্মবর্জিত সার্বজনীন সংস্কৃতি চর্চার একটি মান্য ধারার (১লা বৈশাখকে কেন্দ্র করে মঙ্গল শোভাযাত্রার) জন্ম দেওয়ার চেষ্টা চলছে। যদিও তা আমাদের আলোচনার মূল অনুসারী নয়।

সুতারং ধর্মকে বর্তমান সময়ে সংস্কৃতি বলে চালানো যাবে না। চালাতে গেলেই বিচ্ছিন্নতার মনোভাব মাথাচাড়া দেবে এবং দেবেই। আজকের ভারতের দিকে তাকালেই তার জলজ্যান্ত উদাহরণ হামেশাই নজরে পড়ছে। হিন্দু বা হিন্দুত্বকে সংস্কৃতি বলা এবং তাকে ভারতীয় সংস্কৃতির মান্যতা দিয়ে অন্যকে তার অধীনে আনতে গিয়েই যে আজ অস্থিরতার সৃষ্টি হচ্ছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

তাই, বিশেষ এক ধর্মমতকে সংস্কৃতি বলে এবং তাকে বিদেশি মানুষ গ্রহণ করছেন বলে তাকে প্রশ্রয় দিলে তোমার-আমার মনের উদারতার দিকটি প্ৰকাশ পাবে ঠিক, কিন্তু আমজনতার মধ্যে এই উদারতা প্রকারান্তরে সংকীর্ণতার প্রসার ঘটাবে। কেননা, এইভাবে ভাবতে গেলে যে মানবতাবাদী চেতনা, প্রগতিশীল ধ্যানধারণা ও কুসংস্কারমুক্ত বিজ্ঞানমনস্ক মন দরকার তা আজও আমাদের দেশে অতি বিরল বিষয়।

দ্বিতীয়ত, কেন বিরল বিষয়, তার কারণ অনুসন্ধান নিশ্চয়ই জরুরি।

আমরা অনেকেই তার কিছু কিছু জানি। আমরা জানি যে এই ধরণের পরিস্থিতির জন্য আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা এবং শিক্ষার সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত মানুষদের চেতনাহীনতাই একটা বড় কারণ। এখানেই উঠে আসবে সেই একই কথা। সংস্কৃতির নাম করে স্কুল ও মাদ্রাসাগুলোতে ধর্মীয় রীতিনীতি শেখানোর ধুম লেগে আছে। আমরা জানি সরস্বতী পূজা বা নামাজ পড়া-না পড়ার সাথে শিক্ষা লাভ বা পাসফেলের কোনো সম্পর্ক নেই। তবু আমরা শিক্ষকরাই স্কুলগুলোতে  ঢাকঢোল পিটিয়ে পূজা করি (মাদ্রাসাগুলোতে অন্য বিষয়কে কেন্দ্র করে ) এবং এই অজুহাতে কমপক্ষে একাধিক দিন পঠনপাঠন লাঠে তুলে দেই।

আমরা একবারও ভেবে দেখিনা, ধর্ম বিষয়টি পুরোপুরি বিশ্বাসের বিষয়। এখানে যুক্তি বুদ্ধির কোনো জায়গা নেই। প্রশ্ন করার কোনো সুযোগ নেই। অথচ আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থার একমাত্র ভিত্তি হচ্ছে যুক্তিবাদ। এই যুক্তিবাদী মন প্রশ্ন করতে শেখায়। জগৎ ও জীবনের রহস্য ভেদ করতে শেখায় ও সাহস যোগায়। দূঃখের বিষয়, শিক্ষার নাম করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিশ্বাসের বীজ বুনছি। কোমলমতি মনে ঢুকিয়ে দিচ্ছি সেই আপ্তবাক্য, বিশ্বাসে মেলায় বস্তু তর্কে বহুদূর। অথচ আসল সত্য ঠিক এর উল্টো - যুক্তিতে মেলায় বস্তু বিশ্বাসে বহুদূর। ফলে আমরা লেখাপড়া শিখছি কিন্তু শিক্ষিত হতে পারছি না।

আর এই যেখানে শিক্ষা ও চেতনার হাল সেখানে কোথায় আছে তোমার-আমার চেতনা যা উদার হওয়ার শিক্ষা দেয়। চারপাশে তাকালে দেখতে পাই আমরা ভয়ঙ্কর রকমের সংখ্যালঘু।

সুতরাং, বিশ্বাসের বিষবাষ্পকে ঘরে ঢুকিয়ে তার সঙ্গে অসম লড়াই করার চেয়ে তাকে আটকানোটা বুদ্ধিমানের কাজ বলেই মনে হয়।

Comments

Popular posts from this blog

বাংলা সাহিত্য : সম্পাদকীয় - সমাজ বদলাবে - এটাই চিরন্তন - আলী হোসেন

সমাজ বদলাবে - এটাই চিরন্তন সমাজ বদলাবে - এটাই চিরন্তন। মানব সভ্যতার সূচনা থেকেই শুরু হয়েছে এই বদলে যাওয়ার যাত্রা। সেই যাত্রা মানুষ থামায় নি, থামবেও না। কিন্তু বদলে যাওয়ার গতি এতটাই বেগবান হয়েছে যে, একে আর‘ধীর গতি’ বা বাতাসের ‘মৃদুমন্দ’ গতির সাথে তুলনা করা যাচ্ছে না। বিগত তিন দশক ধরে তথ্যপ্রযুক্তিকে হাতিয়ার করে মানব সভ্যতা যে বেগে বিকশিত হচ্ছে তার তুলনা ইতিহাসে নেই। আর একারণেই এই বদলে যাওয়াকে আমরা কোন মতেই উপেক্ষা করতে পারব না।   সাহিত্য চর্চার মাধ্যম এই ‘বদল-ঝড়ের’ মুখে পড়েছে। মুদ্রণ-নির্ভর সাহিত্য চর্চার যে ধারা, তার বিকল্প মাধ্যম মুদ্রণ-সাহিত্যের ঘাড়ে বিষ-নিঃশ্বাস ফেলছে। এই বিকল্পকে (বদলকে) মেনে নেওয়া ছাড়া কোন উপায় নেই। আর এই বদলে যাওয়া মাধ্যমটাই হল ‘অন-লাইন’ মাধ্যম। বদলাতে যখন হবেই, তখন আসুন-না, একটু আগে-ভাগেই বদলাই।   তাছাড়া, অন-লাইন মাধ্যমের কিছু সুবিধাও আছে। ১) প্রতেক পাঠক লেখা পড়ার পর নিজস্ব মতামত জানানোর স্বাধীনতা পায়, মুদ্রণ-সাহিত্যে যা সবসময় পাওয়া যায় না। এতে পাঠক-লেখক কাছাকাছি আসতে পারেন দ্রুত এবং সহজেই। ২) পাঠকের ভৌগোলিক সীমানা সীমাহীন হয়ে যায়। ৩) পাঠক

বাংলা সাহিত্য : সম্পাদকীয়। অক্টোবর। ২০২০। আলী হোসেন

সমাজতন্ত্রই প্রকৃত পথ। সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে লক্ষ্যে পৌঁছানোর পদ্ধতি এবং প্রকৌশল বদলায়। বিংশ শতাব্দীর পৃথিবীতে যে পদ্ধতিতে বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে, সেই পদ্ধতিতে বিপ্লব (পরিবর্তন) করা আজ অনেক কঠিন। তার প্রয়োজন আছে বলেও আমার মনে হয় না। মতপার্থক্যের কথা বলছেন? তা তো থাকবেই। ধনতান্ত্রিকদের মধ্যে মত পার্থক্য নেই? তারা বিভিন্ন দলে বিভক্ত নয়? সুতরাং মতপার্থক্য থাকবে। আর এটাই স্বাভাবিক। এই মতপার্থক্যকে মতৈক্যে পরিণত করার দায় এবং দায়িত্ব একমাত্র জনগণেরই নিতে হয়। আমার, আপনার এবং আমাদেরই নিতে হবে। আমরা যদি বুঝতে পারি, দুটো অর্থনৈতিক ব্যবস্থার (ধনতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক) মধ্যে কোনটা আমাদের জন্য উপযুক্ত, তাহলে সেই ব্যবস্থার সমর্থকদেরকে আমাকে নির্বাচিত করতে হবে। তারা বহু দলে বিভক্ত হলেও, একটি নির্দিষ্ট মতাদর্শের ভিত্তিতে তারা ঐক্যবদ্ধ হতে পারে। ঐক্যবদ্ধ যে হতে পারে, তার উদাহরণ বামফ্রন্ট তৈরি হওয়া, ইউপিএ তৈরি হওয়া এবং এনডিএ তৈরি হওয়া। মানুষ যেদিকে যাবে, রাজনৈতিক দল সেই দিকেই পথ হাঁটতে বাধ্য হবে। এটাই ইতিহাসের শিক্ষা। এখন আমি বা আপনি, এককথায় আমাদেরকেই ঠিক করতে হবে, আমরা কোন মতাদর্শের পক

বাংলা সাহিত্য : সম্পাদকীয় : চেতনার জন্ম কিংবা মৃত্যু

সম্পাদকীয় : চেতনার জন্ম কিংবা মৃত্যু শিক্ষা আনে চেতনা আর চেতনা আনে বিপ্লব। এটা যে শুধু স্লোগান নয়, পরম সত্য তা আরও একবার প্রমানিত হল। প্রামাণ করলো ছোট্ট মেয়ে মালালা ইউসুফজাই। পাকিস্তানের সোয়াত উপত্যকার মেয়ে মাত্র এগার বছর বয়সেই বুঝে ফেলেছে চেতনাহীন মানুষ পূর্ণ-মানুষ নয়; মানুষের রূপ পাওয়া একটা সাধারণ জীব-মাত্র। মানুষের সঙ্গে এইসব জীবের প্রধান পার্থক্যই নিহিত রয়েছে চেতনা থাকা আর না-থাকার মধ্যে। বস্তুত, চেতনা-রহিত মানুষ হিংস্র পশুর চেয়েও ভয়ঙ্কর হয়। কিন্তু লক্ষ্য করার বিষয় হল, হিংস্র পশু ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে মুলতঃ দুটো কারণে। এক. ক্ষুন্নিবৃত্তি দুই. আত্মরক্ষা; যা প্রত্যেক জীবের সহজাত প্রবৃত্তি। আর চেতনাহীন মানুষের ভয়ঙ্কর ও হিংস্র হওয়ার পিছনে এদুটো প্রবৃত্তির কোনটারই কোন ভুমিকা থাকে না। ২৬/১১য় আজমল কাসবরা যা করেছিল কিম্বা মালালাকে যারা হত্যা করার চেষ্টা করেছে তা ক্ষুন্নিবৃত্তির জন্য নয়, আত্মরক্ষার জন্যও নয়। এক্ষেত্রে চেতনার মৃত্যুই একমাত্র কারণ। অন্যদিকে এই চেতনার সরব উপস্থিতিই মালালাকে করেছে বিপ্লবী। চেতনার খোঁজে তার লড়াই শুরু মাত্র এগার বছর বয়সেই। নারী শিক্ষার বিরুদ্ধে তা